মামা সদ্যই তার চাইনিজ গোসল সেরে দাঁড়িয়েছেন। আমার প্রশ্নে ক্ষেপে গালি দিয়ে পুষ্কুরুনীর ঘাটে বাঁশের মাঁচা থেকে যখন আমাকে মারার জন্য দৌড়ানি দিলেন, আমি আল্লাহ্ খোদার নাম নিয়ে বেন জনসন হয়ে গেলাম। পিছনে না তাকিয়ে ভোঁ দৌড়। একটু সামনে আসতেই কলজে কাঁপানো আর্ত চিৎকারে থেমে গেলাম আমি।
ঐ বাবারে........
এই টুকু শব্দের পরে একটা ক্যাক ক্যাক শব্দ হয়ে ঝপাস শব্দে পানিতে কিছু পড়ার আওয়াজ হলো। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম গায়ে জড়ানো জাম্পার আর কাঁথার পোটলা পুটলি সহ মামার অর্ধেক শরীর পানির নিচে। আর হাতদুটো দিয়ে কোন মত ঘাটলার বাঁশের মাঁচা ধরে ঠক ঠক করে কাঁপছেন।
আমি তখন দোটানায় এবং বেশ ফাঁপড়ে আছি। এক মন বলছে "আহারে মামার কত কষ্ট.... তাড়াতাড়ি গিয়া তুইলা ফেল্"। আরেকবার বিড় বিড় করে বললাম-
শালারপুত, আমারে খালি গালি দেও আর মারতে আস, উচিত বিচার হইছে। লোকে কয় ভাগিনা মারলে হাত কাঁপে, এখন দেখ্ হুদাই হাত কাঁপে না, পুরা শইল ঐ কাঁপে।
আমি দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলাম।
ঐ হালার পো আমারে দইরা তোল। তর নানী যদি দেহে খেতা ভিজাইয়া ফালাইছি তাইলে তর নানা হালারপুতে আমারে খাইছে।
মামা তোমারে তোলা যাইব না। তুমি আমারে খালি গাইল দেও আর মারতে আস। তোমার গালি-গালাজে শালীনতার ভিগ্ন ঘটে বইলা বিন আরফান মামা অভিযোগ জানাইছে।
বাপরে মাফ চাই, এহন থেইকা আর গাইল দিমু না। বাপ আমার আমারে দর নাইলে কিন্তু মইরা যামু। তহন মামা পাবি কই?
আমিও ভাবলাম আসলেই তো ঠিক, এমন আজব মামা আর পাব কোথায়। দৌড়ে গিয়ে মামাকে তুলে আনলাম। ঘাট থেকে মামা আর একা হেটে ঘরে আসতে পারলেন না। আমার কাঁধে হাত রেখে কোন মতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে এলেন।
সারাটা রাত মামার মুখটা ভীষণ মলিন হয়ে রইল।
মামা কুলসুমরে দেখতে যাইবা না? আইজকা না তোমার ডেট!
সাত সকালে আমার এই কথা শুনে ভেটকি মাছের মত মুখটা হা করে থাকলেন, শুধু একটা ফোস আওয়াজ বেরুলো মামার মুখ থেকে।
সামনেই ভালবাসা দিবস, প্রতি বছরের মতো মামা কুলসুমের জন্য উঠোনের এক কোনে বড়সড় একটা হাইব্রিড গোলাপ বাগান করেছেন। ছয় ইঞ্চি ব্যাসের বড় বড় গন্ধহীন গোলাপগুলো যখন ফোটে দেখতে ভালই লাগে। আপাতত লেংড়া মামার কাজ হলো আমাকে দিয়ে এই গোলাপ বাগানের পরিচর্যা করানো। সকালে উঠে গাছগুলোতে পানি দেয়া, গোয়াল ঘরের পেছনে যে গোবর পঁচে আছে তা এনে গাছের গোড়ায় দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভাবছেন আমি খুব শখ করে এই কাজগুলো করি। মোটেও না, আমিও মিজান মামার ভাগিনা, মনে মনে বলি-
শালারপো গোলাপ গাছ মোড়াইয়া তোমার ............ দিমুনে, ইট্টু বড় হইয়া লই।
মনে মনে ঠিকই একটা শয়তানি বুদ্ধি ঝালিয়ে নেই।
আমার জানামতে জগতে মিজান মামা মাত্র দুইটা মানুষরে ভয় পায়। একজন আমার নানা, আরেকজন ছোটখালার ছয় বছরের মেয়ে শমী। এই রকম একটা পুঁচকে মেয়েকে কেন ভয় পায় প্রশ্ন জাগছে তো! ওর বয়স যখন তিন- তখনও বিছানায় হাগু-হিসি করে। একদিন ছোট খালা রাগ করে বললেন-
শমী তুমি যদি আর বিছানায় হাগু কর তাহলে তোমার পাছা কেটে দিব।
সারা দিন না খেয়ে মুখ ভার করে বসে থাকে। রাতে যখন খালু বাসায় এলেন শমী কাঁদতে কাঁদতে বলল-
বাবা, এখনই তোমার বউটারে বাড়ি থেকে বের করে দিবা। তোমার বউ বলে কিনা আমার পাছা কেটে দিবে। বলতো বাবা আমার পাছা কেটে দিলে আমি হাগু করব কি দিয়ে?
বোঝেন এবার, তিন বছর বয়সেই যদি এমন কথা বলে, তাহলে এই তিন বছরে তার বুদ্ধির পাহাড় কত বড় হয়েছে?
এমনিতেই মামার জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি তার মধ্যে মামার এঙ্েিডন্টের খবর শুনে ছোটখালা তার মেয়ে শমীকে নিয়ে এসে হাজির। এখন এই শমীকেও সামলাবার দায়িত্ব আমার।
বিকাল থেকে রাতটা ভালয় ভালয় কেটে গেল। শমী নানার পালা ছাগলের বাচ্চাগুলোকে নিয়েই মেতে থাকল।
পরদিন মামা ঘুম থেকে উঠেই পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন।
কোন ছাগলে আমার গোলাপ গাছ খাইলরে?
আমি ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকি। কেয়ামত হলেও আমার কিছু যায় আসে না। লেংড়াতে লেংড়াতে মামা ঠিকই আমার বিছানায় এসে হাজির হলেন।
ভাইগনা তুই ক, আমার গোলাপ গাছগুলোর এমন হাল করছে কোন হালার পুতে?
গভীর ঘুমের ভাব ধরে নাকে ঘ্রা ঘ্র শব্দে সমানে নাক ডেকে যাচ্ছি আমি, তবুও নড়া চড়া করছি না। মামা লেংড়াতে লেংড়াতে বেরিয়ে গিয়ে নানার ছাগল গুলাকে ধরে নিয়ে এলেন।
আয়েশ করে আমার বিছানায় বসলেন। বসেই ধরে আনা বড় ছাগলটার কান ধরে লাগলেন এক চড়। চড় খেয়ে ছাগল ডাকে ম্যাহে হে , ম্যাহে হে, ম্যাহে হে। ছাগল যতই ম্যা ম্যা করছে ততই মামার রাগ সপ্তমে চড়ছে। আর তাতে ফল হচ্ছে আরেকটা চড়া বোনাস
অই হালার ছাগলের বাচ্চা ম্যা ম্যা করবি না। ক আর গাছ খামু না।
বলেই আবার চড় লাগালেন। একটাকে ধরেন, চড় মারেন আর বলেন-
ক আর গাছ খামু না।
ছাগল উত্তর দেয়-
ম্যাহে হে , ম্যাহে হে, ম্যাহে হে।
মামার কথা ছাগলের কানে ঢুকেছিল কি না বুঝতে পারি নি। কিন্তু আমার কারনে যে ওরা মার খাচ্ছে সেটা ভেবে কষ্ট হচ্ছিল।
ইতোমধ্যে শমী এসে উপস্থিত।
মামা ছাগল গুলাকে মারছ কেন? আর ওরা কি তোমার কথা বুঝতে পারবে? তুমি বুঝ ছাগলের কথা? আর ছাগল যদি তোমার সাথে কথা বলা শুরু করে তাহলে দুজনের পার্থক্য কী? অবশ্য নানাও তোমাকে ছাগলই বলে, হি হি হি হি।
মামা এবার একটু থামলেন। বলাতো যায় না এই শমীটা আবার কি বলে বসে।
সব দোষ তোমার; গোলাপ কি! আর ঘাস কি! সেটা বুঝার ক্ষমতা ছাগলের নাই। ওদের কাছে সবই খাদ্য। তোমার উচিত ছিল বাগানে বেড়া দিয়ে রাখা। ভুল তোমার.....
শহুরে স্কুলে পড়া শমীর দিকে আমি একটা শ্রদ্ধার দৃষ্টি নিয়ে তাকাই। যাক্ আমি যা বলতে বা বুঝতে পারি নি শমী সেটা বুঝেছে এবং উচিত বলেছে।
মামা এবার ছাগলের পা ধরো। পা ধরে হাউ মাউ করে কাঁদবে আর মাফ চাইবে। কি দেরি করছ কেন? নানাকে ডাকব?
আমি ফিক করে হেসে দিলাম। মামার ভয়ের একটা যম হুকুম করছে, আবার আরেকটা যমের ভয় দেখাচ্ছে। দেখি এইবার মামা তুমি যাও কই।
শমী ছাগলের তো পাও চাইট্টা, মামা কোন পাও ধরব হেইডা ইট্টু কইয়া দে না।
হাসতে হাসতে আমার মুখ ফসকে কথাগুলো বেরিয়ে যায়। মামা আমার দিকে হায়েনার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। ভাবটা এমন "হালার পুত তর শমী বইন তো আর হারা জীবন থাকব না, অরা যাক তার পর তরে বুঝামুনে ছাগলের পাও কয়ডা"।
নানাকে এগিয়ে আসতে দেখে মিজান মামা তাড়াতাড়ি ছাগলের পিছনের দুটো পা ধরে কান্নার অভিনয় শুরু করলেন।
কিরে হারামজাদা, তুই আমার ছাগলের পাও দইরা রাখছস ক্যান? নানা এসে প্রশ্ন করেন।
বাজান কবিরাজে কইছিল পায়ে দুখ পাইলে ছাগলের পাও দইরা কানলে নাকি ঠিক অইয়া যায়। হেল্লেইগা..............
খাড়া তর আর তর কবিরাজী হিগাইতাছি।
সু্স্থ্য থাকলে মিজান মামার ছায়াটাও দেখা যাওয়ার কথা না, তবে আজ আর মামা দৌড় দিতে পারলেন না। নানাও ধমক দিয়ে উল্টা পথে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। আর ছাগলের পা ছেড়ে দেয়ার সময় উপরি পাওনা লাথি জুটল মামার ঠিক কপাল বরাবর।
আমি সুযোগ বুঝে মামার ভাষার শালীনতা বিষয়টা শমীর সামনে পাড়লাম। ভাবলাম শমীকে দিয়েই মামাকে শায়েস্তা করা যাক। ফল হলো উল্টো, শমী আমাকেই জ্ঞান দিয়ে দিলো-
দেখ ভাইয়া প্রতিটি জীবেরই আলাদা ভাষা আছে। সেটাতেই তারা আরাম বোধ করে। তাদের সে ভাষাতেই কথা বলতে দাও। নানা যে মামাকে বকা দেয় সেটাতে মামা কি কিছু মনে করে? করে না। এটায় তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শুধু বকাটা না দেখে ভেতরের আদরটাও দেখতে হবে। আর অন্যকে সম্মান দিলে নিজেও সম্মান পাবে। এই যে আমি এখানে যে ভাবে শুদ্ধ করে কথা বলি তাতে আমার বয়সি সবাই হাসে। তাদের কাছে এটা ন্যাকামো মনে হয়। আর গালির কথা বলছ! আমি অনেক বিদেশী ভাষার ছবি দেখেছি যেগুলোতে গালি-গালাজের পরিমান মামা-নানার চেয়েও অনেক বেশি।
তুমি এত কতা জান ক্যামনে?
আমাদের স্যার শিখিয়েছেন। উনার দাদা মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন।
ছোট্ট শমীর জন্য আমার সম্মান বেড়ে যায়। মনে মনে বলি-
যাক দুইচাইট্টা গালি দিলে শালীণতার ভিগ্ন তাইলে ঘটে না। বিন আরফান মামা তোমার অভিযোগের কিছু আর করা গেল না। মাফ দিও মামা।
দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন কেমন করে চলে গেল, কালই ভালবাসা দিবস। মামার বাগান জুড়ে গোলাপের সুন্দর কলিগুলো সূর্যের দিকে মুখিয়ে আছে। মুখিয়ে আছে আলো দেখার। আর আমি দেখছি মামার চোখে ভালবাসা পাবার লোভের জল চিক চিক করছে। আমার খুব হাসি পাচ্ছে।
মামা আমরা আজ চলে যাচ্ছি। তোমার বাগানের সবগুলো গোলাপ আমার, একটাও যদি ছিড়ে ফেল তাহলে তোমার খবর আছে।
আমার হাসিটা আরো প্রশস্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে বলি
পানি টানাইছ, কিছু কই নাই। গোবর টানাইছ, কিছু কই নাই। এইবার পারলে একটা ফুল ছিড়া দেখাও।
মামা শুধু চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাসই ফেলতে পারেন। আর কিছু করার নাই। শত হলেও দুই যমের একজনের হুকুমতো।
ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখ মিজান মামা আবার ক্ষেপলেন। তার বাগানের ফুটে থাকা একটা ফুলও নেই। যথারীতি সন্দেহের দৃষ্টি আমার দিকে।
কিরে হালার পুত, ফুলগুলা কি করছত? ফুল ছিড়া আবার শমীরে খবর দিবি আমি ছিড়ছি? চালাকি হিকছছ!
মামা উল্টা পাল্টা কতা কইবানা। ফুল আমিই ছিড়ছি, আর ঐগুলা আমি শ....মি...রে দিয়া আসছি।
কি! এই বয়সে তুই আমার ভাগনিরে ফুল দেস্ । পীড়িত হিগছস?
আমি হাসতে হাসতে বলি-
আরে মামা শমীরে না শহীদ মিনারে দিয়া আসছি। তোমার লগে একটু মজা লইলাম। শমী সেদিন কি কইছিল মনে নাই? যারা এই ভাষার মান রাখতে জীবন দিছিল, তাগর লাইগাই তুমি আইজ আমারে এত আদর কইরা গাইল দিতে পার।
মামা তোমার বাগানের ফুল কি এর চাইতে বেশি সম্মানের কাজে লাগাইতে পারতা?
উজ্জল দুটো চোখে হাসিমুখে মামা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
এই প্রথম মামার ভেতর আমার জন্য একটা শুদ্ধ গর্বের অনুভুতি দেখতে পেলাম।
০৭ জুন - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪